দ্বিতীয় অধ্য়ায়

 

দ্বিতীয় অধ্যায়


দ্বতীয় অধ্যায় 



সাংখ্য-যােগ

সঞ্জয় কহিলেনঃ-

অশ্রুজলে অভিসিক্ত দেখিয়া অৰ্জ্জুনে। 

মন স্থির করে তার প্রবােধ বচনে।। 

মৃদু হাসি কহিলেন দেব নারায়ণ।

ত্যজ শােক উঠবার শুনহ বচন।।১

শ্রীভগবান কহিলেনঃ –

এই ঘাের দুঃসময় হেন মােহ ভার। 

কেমনে গ্রাসিল দেখি হৃদয় তােমার।।২

না হও ব্যথিত সখা তুমি এ সময়। 

ছিঃ ছিঃ হেন অবসাদ সাজে না তােমায়।।

ত্যাগ করি কৈব্যভাব ওঠ ধনঞ্জয়।

হেন অধীরতা সখা তব যােগ্য নয়।।৩ 

অর্জুন কহিলেনঃ –

কিরূপে করিব রণ ভীম-দ্রোণ সহ। 

পূজ্যপাদ গুরুজন নারায়ণ কহ।।৪

ভিক্ষান্ন ভােজন শ্রেয়ঃ শুন ওহে হরি। 

গুরুজন বধ আমি কেমনেতে করি।।৫ 

বাঁচিতে চাহিনা মােরা বিনাশি যাদের। 

সেই ধৃতরাষ্ট্র পুত্র সম্মুখে মােদের।।৬ 

কুলক্ষয় ভয়ে হিয়া করে হাহাকার। 

উপদেশ দেহ মােরে বিশ্ব-মূলাধার।।

শরণ লইনু হরি চরণে তােমার। 

শিষ্যে তব শিক্ষাদান কর এইবার।।৭ 

এই মহা শােক হ’তে পাইতে নিষ্কৃতি।

কোন পথ নাহি হেরি ওহে বিশ্বপতি।।৮ 

সঞ্জয় কহিলেনঃ—

করিব না রণ আমি শুন হে মাধব। 

লাগেনা কিছুই ভাল নেহারি এসব।।৯ | 

উভয় সেনার মাঝে পার্থরে তখন। 

হেরিয়া চিন্তিত হয়ে কহে নারায়ণ৷৷ 

কি কারণে চিত্ত তব হয়েছে বিকল৷৷ 

পরিহর শােক সখা হইতে সফল।।১০

শ্রীভগবান কহিলেনঃ-

কখনাে উচিত নয় সকলের তরে।। 

শােক করা ধনঞ্জয় এ ভব সংসারে।।

জীবিত বা মৃত, তরে পণ্ডিত যে জন। 

শােক নাহি করে বৃথা তােমার মতন।।১১

তুমি কিংবা আমি এই নরপতিগণ।। 

সকলেই বিদ্যমান রয়েছে যেমন। 

আগেও ছিলেন তারা যেমন এখন। 

অতঃপর থাকিবেন শুন দিয়া মন।।১২ 

শৈশব হইলে শেষ আসিবে যৌবন।

যৌবনের পর জরা বিধির লিখন।। 

শেষ হলে এক দশা অন্য দশা ভােগ। 

দেহান্তেও মানবের দেহান্তর যােগ।। 

অবিনাশী আত্মা এই স্থির জেনাে মনে।। 

শােক নাহি যায় সখা পণ্ডিতের স্থানে।।১৩ 

বিষয়ের সহ হলে ইন্দ্রিয় সংযােগ।

তখনই শীততাপ সুখ-দুঃখভােগ। 

কিন্তু সে সকলি হায় কতক্ষণ তরে।।

দেখিতেছি এই আছে এই নাই পরে।।১৪

সুখ-দুঃখ সমজ্ঞান যেইজন করে। 

চঞ্চল করিতে যারে ইন্দ্রিয় না পারে।

প্রকৃত মােক্ষের যােগ্য এ ধরায় তিনি।

 কহিতেছি ইহা আমি শুন হে ফালুনি।।১৫ 

আত্মরূপে সৰ্ব্বভূতে যিনি বিদ্যমান। 

অবিনাশী সর্বদশী সদা দৃশ্যমান।

অব্যয় স্বরূপ যিনি তাহার বিনাশে।। 

নাহিক কাহারাে শক্তি সেইজন ধ্বংসে।।১৬-১৭

করে হনন আত্মা কাহারে কখন। 

অথবা কাহার দ্বারা না হয় নিধন।। 

এই আত্মা হন্তা হয় যাহার ধারণা। 

হতও অন্যের দ্বারা করে বিবেচনা।।।

সেই ব্যক্তি মহা মূখ আত্মার বিষয়। 

জানেনা কিছুই ইহা জানিহ নিশ্চয়।।১৮-১৯

অব্যয় অনাদি আত্মা সমভাবে রয়। 

তার নাহি হ্রাস বৃদ্ধি নাহি তার ক্ষয়।।২০ 

নিত্য অবিনাশী আত্মা জানে যেইজন।

করিবেন কেমনেতে তারে বিনাশন।।২১ 

জীর্ণবাস লােকে যথা করে পরিবার। 

নূতন বসন ল’য়ে করে ব্যবহার।। 

সেইরূপে জীর্ণদেহ করি পরিহার। 

করে আত্মা নবদেহ ধারণ আবার।।২২ 

ইহাকে বধিতে কভু অস্ত্র নাহি পারে। 

করিতে দহন বহ্নি নাহি পারে তারে।। 

ইহাকে করিতে সিক্ত নাহি পারে জল।

পারে উড়াতে তারে পবন প্রবল।।২৩ 

নাহি হয় ইহা ছিন্ন দগ্ধ নাহি হয়। 

ক্লেদাক্ত না হয় কভু নিত্য সর্বময়।।

অচল অক্ষয় আত্মা সর্ব বিদ্যমান। 

সদা একরূপ ইনি ভিন্ন নাহি হন।।২৪

এইরূপ জ্ঞাত হয়ে স্বরূপ আত্মার। 

ওহে সখা কর এবে শােক পরিহার।।২৫

জনম হইলে হবে অবশ্য মরণ।

পুনরায় কৰ্ম্মবশে জনম গ্রহণ।। 

অতএব ত্যাগ কর বৃথা শােক ভার।

করিবেন কেমনেতে তারে বিনাশন।।২১ 

জীর্ণবাস লােকে যথা করে পরিবার। 

নূতন বসন ল’য়ে করে ব্যবহার।। 

সেইরূপে জীর্ণদেহ করি পরিহার। 

করে আত্মা নবদেহ ধারণ আবার।।২২ 

ইহাকে বধিতে কভু অস্ত্র নাহি পারে। 

করিতে দহন বহ্নি নাহি পারে তারে।। 

ইহাকে করিতে সিক্ত নাহি পারে জল।

পারে উড়াতে তারে পবন প্রবল।।২৩ 

নাহি হয় ইহা ছিন্ন দগ্ধ নাহি হয়। 

ক্লেদাক্ত না হয় কভু নিত্য সর্বময়।।।

অচল অক্ষয় আত্মা সর্ব বিদ্যমান। 

সদা একরূপ ইনি ভিন্ন নাহি হন।।২৪

এইরূপ জ্ঞাত হয়ে স্বরূপ আত্মার। 

ওহে সখা কর এবে শােক পরিহার।।২৫

জনম হইলে হবে অবশ্য মরণ।

পুনরায় কৰ্ম্মবশে জনম গ্রহণ।। 

অতএব ত্যাগ কর বৃথা শােক ভার।

কেন কর বৃথা দুঃখ নিমিত্ত তাহার।।২৭ 

আদি অন্তে সখা তবে নাহি জানি যারে। 

নিজের বলিয়া মানি কেমনে তাহারে।। 

কেহ বা ইহারে দেখি বিস্ময়ে মগন। 

বিস্ময়ে কেহ বা করে ইহার বর্ণন।।

কেহ বা বিস্মিত হয় ইহাই শুনিতে। 

শুনিয়াও কেহ পুনঃ না পারে বুঝিতে।।২৮-২৯

অবধ্য অচ্যুত আত্মা দেহ-মধ্যে রয়। 

নাহিক কখনাে তার কোথাও বিলয়।।

জীবের নিধন তরে হইয়া শঙ্কিত। 

কাহারাে নিমিত্ত শােক নহে সমুচিত।।৩০ 

স্বধর্মের প্রতি যদি কর নিরীক্ষণ। 

তােমার এ অনুচিত হৃদয়কম্পন।। 

যেহেতু এ ধৰ্ম্মযুদ্ধ জেনে রাখ ভাই। 

ক্ষত্রিয়ের এর চেয়ে বড় কিছু নাই।।৩১ 

যে ক্ষত্রিয় পায় হেন রণ ভাগ্যফলে। 

তার সম সুখী নাহি কেহ ধরাতলে।।৩২

যদি নাহি কর তুমি এ ধৰ্ম্ম-সমর।।

যশ ধৰ্ম্ম নাশে পাপ ঘটিবে বিস্তর।।৩৩।

সকলে ঘষিবে তব দুর্নাম অক্ষয়। 

মানীর দুর্নাম মৃত্যু চেয়ে বেশী হয়।।৩৪ 

যাহাদের কাছে তুমি পাও সদা মান। 

তাহাদের কাছে তুমি হবে হতমান।। 

তাহারা জানিবে তুমি ভয়েতে কাতর। 

নাহি হও আগুয়ান করিতে সমর।।৩৫ 

বিপুল মিথ্যায় নিন্দা করিয়া তােমার।

অকথা কুকথা বহু করিবে প্রচার।। 

দেখ সখা বিবেচনা করি ভাল মতে ।। 

কি আর দুর্দশা বল আছে ইহা হতে।।৩৬ 

যুদ্ধে যদি হয় সখা তােমার পতন।

অনায়াসে স্বর্গধামে করিবে গমন।। 

করিলে বিজয় তুমি পাবে রাজ্য ধন।। 

ত্যজ পার্থ অধীরতা কর এবে রণ।।৩৭

সুখ-দুঃখ লাভ লাভ জয়-পরাজয়। 

এ সকলি সমজ্ঞান মনে যদি হয়।। 

সুনিশ্চয় নাহি ইথে পরশিবে পাপ।

অগ্রসর হও রণে ত্যজি শােক তাপ।।৩৮ 

সাংখ্য যােগ তত্ত্ব-জ্ঞান করিলে শ্রবণ। 

করিলাম সবিশেষ তােমারে বর্ণন৷৷৷ 

চিত্তশুদ্ধি কৰ্ম্মযােগে কি প্রকারে হয়। 

সর্বাগ্রেই তাহা আমি কহিব তােমায়।। | 

এ জ্ঞান পাইলে সখা আর কদাচন। 

সহিতে না হবে কভু করে বন্ধন।।৩৯। | 

সামান্যও কৰ্ম্ম যদি কাম শূন্য হয়। 

সুনিশ্চিত দুরে যাবে সংসারের ভয়।।৪০ 

ফল প্রাপ্তি আশা নাহি করি কদাচন। 

কৰ্ম্ম কর ঈশ্বরের প্রীতির কারণ।।৪১ 

যজ্ঞ আদি ক্রিয়াকাণ্ড বেদের বিহিত। 

অজ্ঞ যারা তাহাদের তাই মনােনীত।। 

জন্ম কৰ্ম্ম ফল ভােগ লাভ সুনিশ্চিয়। 

সাধনে সকাম কৰ্ম্ম জেনাে ধনঞ্জয়।।৪২-৪৩

ভােগ আর ঐশ্বয্যেতে রত সদা যারা। 

কখনাে নিষ্কাম বুদ্ধি নাহি পায় তারা। 

বিলাস ব্যসনে সদা মুগ্ধ যার মন।।

সমাধি লাভের যােগ্য না হয় সে জন৷৷৪৪

বাণী কূপ তড়াগাদি ক্ষুদ্র জলাশয়ে। 

কাৰ্য্য সিদ্ধ করে লয় মানব নিচয়ে।।

যে সব সাধনা সিদ্ধ মহাদে হয়।। 

অভাব বলিয়া কিছু কারাে নাহি রয়।।৪৫

সেইরূপ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়াছে যার। 

বেদোক্ত কৰ্ম্মের নাহি প্রয়ােজন তার।।

ঈশ্বর সাধনে হয় সৰ্ব্বকৰ্ম্মফল। 

তবে কেন রত হও অন্য কর্মে বল।৪৬-৪৭ 

আসক্তি ত্যজিয়া কৰ্ম্মে হও অগ্রসর।

ঈশ্বর উপর কর সকল নির্ভর।। 

সিদ্ধি ও অসিদ্ধি উভে সমতুল্য জ্ঞান। 

যােগ নামে অভিহিত জানে বুদ্ধিমান।।৪৮

অতএব লও সখা তাহার শরণ। 

সংসারে ঘূর্ণিত হয় ফলকামী জন।।৪৯ 

পাপ পুণ্য বহির্ভুত জ্ঞানযুক্ত যােগী।। 

কৰ্ম্মযােগে যােগী হয় জ্ঞানী সৰ্ব্বত্যাগী। 

কৰ্ম্মের কৌশল যােগ জেনাে গুণধাম।

‘স্থিতপ্রাজ্ঞ’ বলি তারে কহে সুধীজন।।৫৫-৫৬

প্রয়ােজন বােধে কুৰ্ম্ম আপন চরণ। 

আপন শরীর মধ্যে করে যে গােপন।।  

সেইরূপে ইন্দ্রিয়ে যে করয়ে সংযত। 

‘স্থিরবুদ্ধি বলি তিনি হন পরিচিত।।৫৭-৫৮

ইন্দ্রিয় সংযম যারা না পারে করিতে। 

(তার) কামনা না যায় চলি অন্তর হইতে।।৫৯

ইন্দ্রিয় সংযম নহে অধীনে যাহার। 

মিথ্যা সে করে আশা মােক্ষ লভিবার।।

ইন্দ্রিয় বিজয়ী যিনি আমা অনুগত। 

‘স্থিরবুদ্ধি’ বলি তিনি হন অভিহিত।।৬০-৬১

বিষয় বাসনা রত হয় যেই জন। | 

আসক্তি জনমে তার বিষয়ে তখন।। 

কামনাতে ক্রোধ জন্মে ক্রোধে বুদ্ধিনাশ।

বুদ্ধি নাশে নষ্ট হয় জীবনের আশ।৬২-৬৩

বশীভূত যবে হয় ইন্দ্রিয় নিচয়। 

সে ইন্দ্রিয় দ্বারা ভােগ করিলে বিষয়। 

সেই বশীভূত চিত্ত মানব তখন।

শান্তিলাভে বাধা নাহি আসে কদাচন।।৬৪-৬৫ 

ব্ৰহ্ম-চিন্তা হীন যেবা শান্তি নাহি পায়। 

শান্তিহীন বলে তার সুখ বা কোথায়।।  

বিষয় বাসনা রত ইন্দ্রিয় নিচয়। 

যে মন আশ্রয় করে তাহাতে নিশ্চয়।।৬৬  

যে মন তাহার প্রজ্ঞা করে সংহরণ। 

এই নীতিবাক্য মাের করিও স্মরণ।।৬৭

রাত্রির স্বরূপ যাহা দেখে জীবগণ।। 

জাগরিত রহে তাহে সংযমী যে জন।।

যাহাতে জাগিয়া থাকে জন সাধারণ। 

রাত্রে তাহা নিদ্রামগ্ন জানে মুনিগণ।।৬৮-৬৯

জলরাশি পরিপূর্ণ সমুদ্র যেমন। 

বর্ষাবারি দ্রুত ধায় তাহে অনুক্ষণ।।

সেরূপ কামনা রাশি যাহার অন্তর।  

প্রবিষ্ট হইয়া সখা বিলীন সত্ত্বর।।

তিনিই প্রকৃত শান্তি লভে অনুক্ষণ।। 

ভােগার্থী জনের শান্তি নাহি কদাচন।।৭০ 

কামনা ও স্পৃহা ছাড়ি চলে ভবে যেই।।

শান্তি পায় মমতা ও গব্বশূন্য সেই।।৭১ 

ব্রহ্মজ্ঞান-নিষ্ঠা জেনাে পার্থ এ প্রকার।

থাকে সংসার মােহ সাধনে ইহার।। 

চরম কালেও তিনি জানিও নিশ্চয়। 

ব্রহ্মজ্ঞানে নিমগন ব্রহ্মেতে বিলয়।।৭২ 

গীতার সাংখ্য-যােগ সরল ভাষায়। 

পশুপতি রচিলেন দ্বিতীয় অধ্যায়।। 

(সাংখ্য যােগ নামক দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)

Comments