ষষ্ঠ অধ্যায় (অভ্যাস-যােগ)
ষষ্ঠ অধ্যায়
শ্রীভগবান কহিলেনঃ-
ফল-আশা না রাখিয়া যিনি কদাচন।
নিত্য-নৈমিত্তিক কর্ম করেন সাধন।।
তিনিই প্রকৃত যােগী সন্ন্যাসী নিশ্চয়।
যজ্ঞহীন ক্রিয়াহীন সন্ন্যাসী হয়।১.
যােগরূঢ় হতে চান যে মুনি যখন।
কর্মই সাধন-হেতু তাহার তখন।।
যােগারূঢ় অতঃপর তিনি ধনঞ্জয়।।
কর্ম-সন্ন্যাসই তার সাধন নিশ্চয়।।২-৩ .
সমস্ত সংকল্প ত্যাগ যাহার যখন।
ইন্দ্রিয় বিষয়ে নাহি আসক্তি কখন।।
নিবৃত্তি নিশ্চিত যার কর্ম-অনুষ্ঠানে।
যােগারূঢ় তাহাকেই কহে সাধুজনে।।৪
মনকে যে আত্মবশে না রাখিতে পারে।
তার সম নাহি শত্ৰু এই চরাচরে।।
শীত উষ্ণ সুখ-দুঃখ মান-অপমান।
হইয়াছে যে আত্মার সমতুল্য-জ্ঞান।
সংযত প্রশান্ত পার্থ সে আত্মা নিশ্চিত।
পরমাত্মা সে আত্মায় স্থির সমাহিত।।৫-৭
প্রসন্ন বিজ্ঞান জ্ঞানে যাহার অন্তর।
অবিকার জিতেন্দ্রিয় যিনি নিরন্তর।।৮
মৃত্তিকা-প্রস্তর স্বর্ণে সম যার জ্ঞান।
যােগারূঢ় যােগী তিনি শাস্ত্রের বিধান।। .
পরহিতে ব্ৰতী যিনি স্নেহের কান্ডারী।
সৰ্ব্বজীবে সমভাব দরশনকারী।।
পাপী তাপী সাধু জ্ঞানী সকলি সমান।
তিনিই পরম যােগী জেনাে মতিমা।।৯
দেহ আর মন সদা বশীভূত করি।
তন্ময় হইয়া ভবে সেই চক্রধারী।।
সুপবিত্র স্থান দেখি পাতিবে আসন।
কুশােপরি মৃগচর্ম করি বিস্তারণ।।
তদুপরি চেলখন্ড হবে আস্তরণ।
তিনীচ নাতি-উচু করিবে আসন।।
আসন স্থাপন করি অচঞ্চল ভাবে।
তিরচিত্ত শুদ্ধমনে তাহাতে বসিবে।।
আত্মশুদ্ধি করি তাহে সমাসীন হয়ে।
সংযত করিয়া চিত্ত ইন্দ্রিয় নিচয়ে।।
একাগ্র মনেতে করি ধ্যানের ধারণা।
অভ্যাস করিবে সদা যােগের সাধনা।।১০-১২
সরল অচল রবে গ্রীবাশির দেহ।
নাগ্রেতে স্থিরদৃষ্টি রাখি অহরহ।।
কোন দিকে দৃষ্টিপাত কভু না করিবে।
নির্ভয়ে প্রশান্ত চিত্তে সতত থাকিবে।।
প্রাণপণে ব্রহ্মচর্য্য করিয়া গ্রহণ।
রহিবে আমারি ভাবে সতত মগন।।
ত্যাগ করি অন্য চিন্তা হবে মৎপর।
আমাতেই সমাহিত করিবে অন্তর।।১৩-১৪
এ হেন প্রকারে চিত্ত করি সমাহিত।
চিন্তাশূন্য হৃদি যােগী রাখিয়া সংযত।।
আমাতেই চিত্ত যার থাকে অবস্থান।
নিৰ্বাণ পরমা শান্তি লভে সুমহান।১৫
অনাহার অত্যাচার নিদ্রা অতিশয়।
অত্যন্ত জাগ্রত ভাবে নাহি যােগ হয়।। ১৬
আহার বিহার নিত্য নিয়মিত যার।
অন্তরে কর্মের চেষ্টা নিয়ত যাহার।।
যার হয় নিয়মিত নিদ্রা জাগরণ।
তিনিই প্রকৃত যােগী মােক্ষ-পরায়ণ।।
নিথর নিষ্কম্প দীপ বায়ুহীন স্থানে।
সুস্থির যােগীর চিত্ত যােগ সমাধানে।। ১৭-১৯
ইন্দ্রিয় অতীত সুখে করি বিসর্জন।
অতীন্দ্রিয় বাক্যাতীত সুখে মগ্ন মন।।
অবিচল চিত্ত সদা আত্ম দরশনে।
অপূৰ্ব্ব অবস্থা হয় সেই যােগীজনে।।২০-২১
পবিত্র অবস্থা লাভ করি ধনঞ্জয়।
যত লভে জগতেরে তুচ্ছ জ্ঞান হয়।।
নাহি থাকে দুঃখ বােধ মহা দুঃখে যার।
যােগের অপূৰ্ব্ব ভাব লাভ হয় তার।।২২
প্রতিকুল যােগ যত কামনা নিশ্চয়।
সঙ্কল্প হইতে তাহা সমুদ্ভত হয়।।
নিৰ্বেদ রহিত চিত্তে সব পরিহরি।।
মনেতে ইন্দ্রিয়গণে নিয়মিত করি।।
গুরু উপদেশ দ্বারা স্থির করি মন।
অভ্যাস করিবে এই যােগ যােগীগণ।।২৩-২৪
অতীব অস্থির মন স্বভাব চঞ্চল।।
ধাবিত সে হ’তে চায় বিষয়ে কেবল।।
প্রত্যাবৃত করে তারে বিষয় হইতে।
রাখিবে সতত তারে আত্মার বশেতে।।২৫-২৬
পাপম্পৰ্শ পরিশূন্য যাহার হৃদয়।
ব্রহ্মভাবে পূর্ণ তিনি হন সে সময়।।
রজোগুণ তার কাছে নাহি থাকে আর।
ক্রমশঃ প্রশান্ত হয় অন্তর তাহার।।২৭
এ প্রকারে যােগীজনে যােগের আশ্রয়ে।
মনকে রাখিবে বশে পাপশূন্য হয়ে।।
অবিদ্যায় নিরর্থক ব্রহ্মের দর্শনে।
অনায়েসে শ্রেষ্ঠ সুখ লভেন ভুবনে।।
নিয়ােজিত না হলেও কলেবর হতে।
জীবমুক্ত হয়ে র’ন পরম সুখেতে৷৷ ২৮
সমাহিত চিত্ত যার যােগেতেই রয়।
নিখিল ব্রহ্মান্ড তার সব ব্রহ্মময়।।
সৰ্ব্বভূতে সমদৃষ্টি আত্মার আপন।
আত্মাকেও সৰ্ব্বভূতে করে দরশন।।২৯
যে পায় দেখিতে মােরে সকল জীবেতে।
ভাগ্যবান সেই জন জেনাে বিধিমতে।।
না হই অদৃশ্য আমি তাহার কখন।
আমারাে অদৃশ্য কভু নহে সেই যেন।।৩০.
সৰ্বভতে বিরাজিত জানিয়ে যে জন।
আমারে অভিন্ন ভাবে করয়ে ভজন।।
সৰ্ব্ব বিষয়েতে যদি রহে মতিমা।
তথাপি আমাতে জেনাে তার অবস্থান।।৩১
সখা পাই সুখ দুঃখ আমরা যেমন।
সকলের পক্ষে তাহা অবশ্য তেমন।।
ভাবিয়া এরূপ যিনি আত্ম তুলনায়।
সর্বজীবে সমভাবে দেখে বসুধায়।।
হে অর্জুন! সেই জন আমার বিচারে।
পরম পবিত্র যােগী নিখিল সংসারে।।৩২
অর্জুন কহিলেনঃ-
সাম্য-যােগতত্ত্ব যেই কহিলে শ্রীহরি।
অপার করুণা তব মুকুন্দ মুরারী।।
নিশ্চল সে যােগতত্ত্ব না পারি বুঝিতে।
মনের চাঞ্চল্য হেতু স্থির নহে চিত।।৩৩
চঞ্চল চপল মন বড় বলবান।
অজেয় ইন্দ্রিয়গণ অতীব প্রধান।।
বায়ুগতি বশ করা কঠিন যেমন।
মনকে সংযত রাখা কঠিন তেমন।।৩৪
শ্রীভগবান কহিলেনঃ-
অসংযত মহাবাহাে সে চঞ্চল যেমন।
ইহাতেই কিছু নাহি সংশয় কখন।।
অভ্যাস বৈরাগ্য বলে তথাচ এমন।
করা যায় সুসংযত কুন্তীর-নন্দন।।৩৫
মন যার সুসংযত বশীভূত নয়।
তারপক্ষে যােগলাভ কভু নাহি হয়।।
আত্মা যার আত্মবশে রহে অনুক্ষণ।
যােগরত্ন লাভ তার সদা অনুক্ষণ।।৩৬
অৰ্জ্জুন কহিলেনঃ-
প্রথমে শ্রদ্ধার বশে যােগের সাধন।।
পরেতে শৈথিল্য হেতু হয় গাে পতন।।।
কহ কৃষ্ণ কি গতি তাহার কৃপা করি।।
কিবা গতি পাবে সেই যােগভঙ্গকারী।।৩৭
স্বর্গ মােক্ষ দুই পথ হারায় সে জন।
নিরাশ্রয় মূঢ় হায় সেই অভাজন।।
অসমর্থ ব্ৰহ্মালাভে হয়ে নারায়ণ।।
ছিন্ন মেঘ সম নষ্ট হবে কি সে জন।।
কৃপাসিন্ধু কর দূর সংশয় মাের।।
কে কহিবে তােমা ছাড়া ভবকর্ণধার।।৩৮-৩৯
শ্রীভগবান কহিলেনঃ-
যােগভ্রষ্টকারী কভু ধ্বংস নাহি হয়।
ইহকালে পরকালে জেনো সুনিশ্চয়
রত থাকে যার মন যােগ অনুষ্ঠানে।।
হবে দুর্গতি তার আমার বিধানে।।৪০
পুণ্যবান ব্যক্তিগণ করে যথা বাস।
বহুকাল সুখে তথা করে যে নিবাস।।
পবিত্র ধনীর কুলে লভিয়া জনম।।
পনশ্চ সাধনা করে যােগভ্রষ্ট জন।৪১
জ্ঞানবান যােগীকূলে জন্মিয়া সে জন।
পৰ্ব আরাধিত যােগ করয়ে সাধন।।৪২
পূর্বজন্ম জ্ঞাত জ্ঞান লভি পুনরায়।
আরাধনা করে পুনঃ মােক্ষের আশায়।।৪৩
পূর্ব কৰ্ম্মশে আর পূর্বের অভ্যাসে।।
স্বভাবতঃ থাকে রত যােগে অনায়াসে।।
বহু জন্ম এই ভাবে সুসাধন করি।
মােক্ষপদ প্রাপ্ত হন শুদ্ধ যােগাচারী।।৪৪-৪৫
যােগীজন শ্রেষ্ঠ হয় তপস্বী হইতে।।
যােগী হও তুমি পার্থ আমার মতেতে।।৪৬
মম পদে মন প্রাণ করিয়া অর্পণ।।
ভক্তিভরে কর তুমি আমার ভজন।।৪৭
অভ্যাস যােগ কহিনু সরল ভাষায়।।
পদ্যছন্দে রচে শশী এ ষষ্ঠ অধ্যায়।।
(অভ্যাসযােগ’ নামক ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত)
পরবর্তী অধ্যায়
Comments
Post a Comment