চতুর্থ অধ্যায় (জ্ঞান যােগ)
চতুর্থ অধ্যায়
জ্ঞান যােগ
শ্রীভগবান কহিলেনঃ-
শাশ্বত এ জ্ঞান-যােগ অব্যয় অক্ষয়।
বলেছি সূৰ্য্যেরে আমি পূর্বে সমুদয়।।
সূৰ্য্য কহিয়াছিলেন মনুকে সাদরে।
কহিলা মনু তাহা ইক্ষাকু নরবরে।।১
এই ভাবে এই যােগ রাজা-ঋষিগণ।
পরস্পর প্রাপ্ত হন যােগ বিবরণ।।২
ভক্ত তুমি সখা তুমি প্রিয় তুমি মম।
জ্ঞানকৰ্ম্ম যােগতত্ত্ব অতি অনুপম৷৷
বলিনু তােমারে আজি নাহি কহি সবে।
উত্তম রহস্য কথা শুন সখা ভবে।।৩
অর্জুন কহিলেনঃ-
বহুপূর্বে জন্মিয়াছে সূৰ্য্য যে তােমার।
জন্মিয়াছ বহু পরে তুমি হে তাহার।।
কেমনে বুঝিব তবে ওহে জনার্দন।
দিবাকরে বলেছিলে যােগ বিবরণ।।৪
শ্রীভগবান কহিলেনঃ-
গিয়াছে হইয়া মাের বহুজন্ম গত।
জনম নিশ্চয় পার্থ তােমার সে মত।।
আদি জানি অন্ত জানি জানি সমুদয়।
রেখেছি জানিয়া আমি ওহে ধনঞ্জয়।।৫
জনম-মরণ নাহি আমার কখন।
নিখিল ঈশ্বর আমি জানে সর্বজন।।৬
হে অর্জুন! ধৰ্ম্মহানি যখনই হয়।
অধর্মের আবির্ভাব ঘটে যে সময়।।
আপনি সৃজন করি আমি আপনায়।
আবির্ভূত হই আমি তখনি ধরায়।।৭
করিবারে পরিত্রাণ যত বুধগণে।।
দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে৷৷
ধৰ্ম্ম-সংস্থাপন আমি করিবার তরে।
অবতীর্ন যুগে যুগে হই ধরাপরে।। ৮
স্বেচ্ছাকৃত নব নব জনম আমার।
অলৌকিক কৰ্ম্ম মাের জেনাে এ প্রকার।।
হে অর্জুন! যথার্থ-ই, জানেন যে জন।
পুনঃজন্ম প্রাপ্ত নাহি করে সেই জন।।
দেহ-অন্ত হলে তিনি আমাকেই পান।
জেনে রাখ এই কথা তুমি মতিমা।।৯-১০
যে ভাবে যে করে পার্থ আমার সাধন।।
সে ভাবে সে পায় কিন্তু আমারে তখন।।১১
ইহলােকে কাম্যকর্মে সিদ্ধি যারা চায়।
দেবপূজা করি তারা মুক্তি নাহি পায়।।
লভয়ে নিশ্চয় মুক্তি নিষ্কাম করমে।
আত্মলব্ধ শান্ত-সুখ বিহিত ধরমে।।১২
গুণ কৰ্ম্ম অনুসারে বর্ণ চতুষ্টয়।।
করেছি সৃজন আমি ওহে ধনঞ্জয়।
সকলের সৃষ্টিকর্তা জানিও নিশ্চয়।।
নির্লিপ্ত নিস্পৃহ আমি অনাদি অব্যয়।।১৩
আমারে না স্পর্শ করে কৰ্ম্ম কদাচন।
স্পৃহা নাহি কৰ্ম্মফলে আমার কখন।।
এরূপ বিদিত যিনি আমারে নিশ্চয়।
কৰ্ম্মজালে বদ্ধ নাহি তিনি ধনঞ্জয়।।১৪
হেন তত্ত্ব জানি যত মােক্ষ পরায়ণ।
করেছেন পুরাকালে কৰ্ম্ম অনুক্ষণ।।
তুমিও তাদের মত ওহে ধনঞ্জয়।
মুক্ত জ্ঞানে করে যাও কৰ্ম্ম সমুদয়।। ১৫
কি যে কৰ্ম্ম কি অকৰ্ম্ম দুইটি বিষয়।
মুগ্ধ হন বিবেকীরা অনেক সময়।।
যে কৰ্ম্মে হইবে তব অশুভ-মােচন।।
সে কৰ্ম্ম তােমারে আমি বলিব এখন।।১৬-১৭
অকর্মে করেন যিনি কৰ্ম্ম দরশন।
কৰ্ম্ম মাঝে আর যার অকৰ্ম্ম সাধন।।
তিনিই মনুষ্য লােকে পন্ডিত প্রধান।
সর্বকৰ্ম্ম অনুষ্ঠাতা যােগী মহাজন।।১৮
নিষ্কাম ভাবে যে করে কৰ্ম্ম অনুষ্ঠান।
জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ যার কর্মের বিধান।।
পন্ডিত বলেন তারে যত সুধীগণ।।
পরম বচন হেন করহে শ্রবণ।।১৯-২০
নিষ্কাম সংযতচিত্ত জিতেন্দ্রিয়গণ।।
সর্ব-পরিগ্রহ যত করি বিসর্জন।।
শারীরিক কৰ্ম্ম মাত্র করেন সাধন।।
পাপে লিপ্ত নাহি হন তিনি কদাচন।।২১
সামান্য লাভেই যার আনন্দ অপার।
নাহি সুখ নাহি দুঃখ নাহি ঈর্ষা আর।
সিদ্ধি অসিদ্ধিতে সদা সমজ্ঞান যার।।
কৰ্ম্ম করে তবু নাহি কবদ্ধ তার।।২২
নিষ্কাম বন্ধন মুক্ত নিঃসঙ্গ যে জন।
চিত্ত যার সমাহিত জ্ঞানে অনুক্ষণ।।
যাগ-যজ্ঞ আদি যত করেন সাধন।।
বিলুপ্ত সমস্ত কৰ্ম্ম তাহার তখন।।২৩
অগ্নি ব্রহ্ম হরি ব্রহ্ম হােতা ব্রহ্মময়।
যজ্ঞাহুতি বস্তু যত ব্ৰহ্ম সমুদয়।।
সর্বকাৰ্যে যেবা দেখে বিশ্ব ব্রহ্মময়।
ব্রহ্ম কৃপা ঘটে তার ভাগ্যে সুনিশ্চয়।।২৪
কৰ্ম্মযােগী দেবযজ্ঞ করে অনুষ্ঠান।
জ্ঞানযােগী ব্ৰহ্ম যজ্ঞে করেন বিধান।।
ব্রহ্মানলে আত্মাহুতি করিয়া প্রদান।
করেন অপর কেহ যজ্ঞ সমাধান।।২৫
স্তোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণ অন্য কোন জন।
সংযম অনলে সদা করেন অর্পন।।
শব্দাদি বিষয়-রাশি অপর সকলে।
করেন আহুতি-দান ইন্দ্রিয় অনলে ২৬-২৭
তপােযজ্ঞ দ্রব্যযজ্ঞ যাগযজ্ঞ যত।
কেহ কেহ অনুষ্ঠান করেন নিয়ত।।
কোন কোন ব্রতধারী শাস্ত্র অধ্যয়নে।।
জ্ঞানযজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন যতনে।। ২৮
ঊর্ধ্বগামী যে নিঃশ্বাস প্রাণ বলে তায়।
অপান নামেতে বায়ু অবধাদিকে ধায়।।।
পূরক রেচক আর কুম্ভক করিয়া।
অপান ও প্রাণবায়ু রাখেন ধরিয়া।।
এই ভাবে প্রাণায়ম করি সম্পাদন।
করে সদা হঠযােগী ব্রহ্ম আরাধনা।।২৯
এইসব যজ্ঞবিৎ ওহে ধনঞ্জয়।
যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে করি সর্বপাপ ক্ষয়।।
করি যত্নে অবশিষ্ট অমৃত ভােজন।
প্রাপ্ত হন অবশেষে ব্রহ্ম-সনাতন।।৩০
যজ্ঞ-অনুষ্ঠান হীন যেইজন হয়।
জানিও হে ধনঞ্জয় এ কথা নিশ্চয়।।
সে হেন ব্যক্তির পক্ষে ইহলােক নাই।
পরলােক অতি দূরে নাহিত কথাই।।৩১
বহুবিধ যজ্ঞ হেন বেদ-অভিহিত।।
সমস্তই কৰ্ম্মজাত জানিবে নিশ্চিত৷৷
সবিশেষে জানি সবে ওহে বীরবর।
কৰ্ম্মবদ্ধ হতে মুক্ত হও অতঃপর।।৩২
এইরূপ বহু যজ্ঞ বেদের বিহিত।
কৰ্ম্ম হ’তে সমুদ্ভুত জানিও নিশ্চিত।
এ তত্ত্ব জানিয়া যবে জ্ঞানাবিষ্ট হবে।
সংসার বন্ধন হতে মুক্তি তুমি পাবে।।৩৩-৩৪
জানিবে এ জ্ঞানতত্ত্ব কুন্তীর কুমার।
হইবে মােহপ্রাপ্ত তুমি পুনর্বার।।
আত্মা ও পরমাত্মা সকল জীবে মম।
দরশিবে সর্বভূতে এক আত্মসম।।৩৫
সকল পাপীর চেয়ে পার্থ ধনুর্ধর।
গুরুতর হও যদি পাপী অতঃপর।।
তথাপি এ জ্ঞান-তরী করিয়া আধার।
উত্তরিবে অনায়াসে জ্ঞান পারাবার।।৩৬
জ্ঞান-সম সুপবিত্র শুদ্ধিবর আর।।
নাহি কিছু বৰ্তমান ত্রিলােক মাঝার।।
যথাকালে আত্মাতেই লভে আত্মজ্ঞান।
কর্মযােগ বিনা কিছু নহে মতিমান।।৩৭-৩৮
শ্রদ্ধাবান ব্রহ্মনিষ্ঠ জিতেন্দ্রিয়গণ।
প্রাপ্ত হন এই জ্ঞান অর্জুন সুজন।।
ইন্দ্রিয়াদি জ্ঞানযােগে করিয়া দমন।
প্রাপ্ত হন পরম পদ সে মহাজন।।৩৯
গুরু-উপদিষ্ট অর্থে অনভিজ্ঞ যেই।
গুরুবাক্যে কদাচিৎ শ্রদ্ধা যার নাই।।
সন্দেহ পূরিত যার মনেতে সদাই।
ইহলােক পরলােকে সুখ তার নাই।।৪০
সংশয় অজ্ঞাত-জাত হৃদয়-নিহিত।
জ্ঞানখঙ্গে ছিন্ন করি সমস্ত নিশ্চিত৷৷
অনুষ্ঠান কর যােগ তুমি অতঃপর।
ওঠ ওঠ, হে অর্জুন! করিতে সমর।।৪১-৪২
জ্ঞানযােগ কহিলাম সরল ভাষায়।
পদ্যছন্দে রচে শশী চতুর্থ অধ্যায়।।
(জ্ঞানযােগ’ নামক চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত)
Comments
Post a Comment